এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার (Adjustment Disorder)

Adjustment disorder

এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার হল এক ধরনের স্ট্রেস-সম্পর্কিত মানসিক অসুস্থতা (stress related mental sickness) যেখানে একজন ব্যক্তি তার বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধু, সহকর্মী, স্বামী-স্ত্রী বা যাদের সাথে তার সম্পর্ক আছে তাদের সাথে মানিয়ে চলতে পারে না। মানুষটি উদ্বিগ্ন বা বিষণ্ণ বোধ করতে পারে এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও করতে পারে। তারা স্বাভাবিক দৈনিক সময়সূচী বা রুটিনকে বিরক্তিকর বা চাপযুক্ত বোধ করতে পারে। তারা বেপরোয়া হয়ে যে কোন ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংক্ষেপে, এই ধরনের লোকেরা জীবনে চলার পথে মানুষের সাথে সুসম্পর্ক ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে পারেনা। তারা কঠিন সময় পার করে যা তাদের ব্যক্তিগত , পারিবারিক তথা সামাজিক জীবনে গুরুতর পরিণতি বয়ে আনে। বেশিরভাগ সময় এরা কয়েক মাসের মধ্যে এই ধরনের পরিবর্তনগুলির সাথে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ যদি ক্রমাগত দু:খিত এবং আত্ম-ধ্বংসাত্মক (self-destructive) বোধ করে তবে তার এ্যাডডাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার আছে ধরে নেয়া যায়।

এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা সাধারণত আক্রান্ত মানুষটিকে স্বাভাবিক মানসিক-আবেগিক অবস্থায় পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে।

উপসর্গ (symptoms): উপসর্গ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হয়। কিন্তু এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই তাদের জীবনের একটি চাপের (stress) ঘটনার তিন মাসের মধ্যে লক্ষণগুলি বিকাশ লাভ করে। 
মানসিক লক্ষণ (mental symptoms):
1. দুঃখ এবং বিষণ্ণতা
2. আশাহীনতা
3. বিনোদনে অনীহা
4. স্নায়বিক দুর্বলতা
5. কান্নাকাটির স্বভাব
6. অস্থিরতা
7. উদ্বেগ যার মধ্যে বিচ্ছেদ উদ্বেগ (separation anxiety) অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে
8. চিন্তা
9. রাগ
10. হতাশা
11. ঘুমের সমস্যা
12. কাজে মনোনিবেশ করতে অসুবিধা
13. কোন কিছুতে সহজেই অভিভূত হয়ে পড়া
14. আত্মহত্যার চিন্তা
 
আচরণগত লক্ষণ (behavioral symptoms):
1. যুদ্ধংদেহী মনোভাব, ঝগড়া-তর্ক করা
2. বেপরোয়া গাড়ী চালানো বা চলাফেরা করা
3. চিন্তা না করে অহেতুক খরচ করা
4. পরিবার/বন্ধু/সহকর্মীদের এড়িয়ে চলা সুসম্পর্ক রক্ষা না করা
5. স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে খারাপ কাজ/ আচরণ করা
6. স্কুল, কাজ বা ব্যবসায়ে অনুপস্থিত থাকার প্রবণতা
7. সম্পত্তি ধ্বংস সাধন করা
প্রকার (types of adjustment disorder):
রোগটি একিউট বা ক্রণিক যে কোন ধরণের হতে পারে। এছাড়া এর সাথে অন্য রোগের আক্রমণে এটি নিম্নলিখিত যে কোন প্রকারের হতে পারে:
1. বিষণ্ণ মেজাজের সঙ্গে এ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডার
2. উদ্বেগ সঙ্গে এ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডার
3. মিশ্র উদ্বেগ এবং বিষণ্ণ মেজাজ সঙ্গে এ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডার
4. আচরণগত সমস্যার সহ এ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডার 
5. আবেগ এবং আচরণের মিশ্র ব্যাঘাত সহ এ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডার
এদের সাথে আনুষংগিক শারীরিক-মানসিক অবস্থাও থাকতে পারে।
 
কারণ (causes of adjustment disorder): গবেষকরা বিভিন্ন কারণ খুঁজে পেয়েছেন। এটি অন্যান্য মানসিক ব্যাধির সাথে দেখা যেতে পারে, কারণটি সম্ভবত জটিল এবং এতে বংশগত রোগপ্রবনতা (genetical predisposition), জীবনের অভিজ্ঞতা (life experiences), হতাশ প্রেম (disappointed love), বিচ্ছেদ বা বিবাহবিচ্ছেদ (seperation, divorce), মেজাজ এবং এমনকি মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক রাসায়নিকের পরিবর্তন জড়িত থাকতে পারে।
ঝুঁকির কারণ (risk factors): শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে, ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই এ্যাডজাসমেন্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার প্রায় সমান সম্ভাবনা দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, নারীদের মধ্যে এই ব্যাধি নির্ণয়ের সম্ভাবনা পুরুষের দ্বিগুণ। ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ঘটনাই এদের মধ্যে চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
কিছু চাপের পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে:
1. গুরুতর শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা 
2. স্কুল/কর্মক্ষেত্রে সমস্যা
3. বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পর্ক বিচ্ছেদ
4. ব্যবসা, চাকরির ক্ষতি/লোকসান
5. পরিবারে নতুন শিশুর জন্মগ্রহণ
6. আর্থিক সমস্যা
7. শারীরিক আঘাত/ দুর্ঘটনা
8. মানসিক ট্রমা/আঘাত
9. দুর্যোগের মোকাবিলার সময়কার পরিস্থিতির মোকাবিলা করা
10. অবসরজনিত বিষয়াবলী/চাপ
11. প্রিয়জনের মৃত্যু
12. নতুন কোন কাজে যোগদান ইত্যাদি
 
কিছু ক্ষেত্রে, যারা চলমান মানসিক চাপজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন যেমন - দীর্ঘদিন যাবত অপরাধপ্রবণ এলাকায় বসবাসের এক পর্যায়ে adjustment disorder দেখা দিতে পারে।
 
জীবনের অভিজ্ঞতার (life experiences):
যদি একজন ব্যক্তি সাধারণত জীবনের নানাবিধ পরিবর্তন ভালভাবে মোকাবিলা করতে না পারেন বা তার পরিবারে বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে একটি শক্তিশালী সমর্থন ব্যবস্থা (support system) না থাকে, তাহলে তার চাপপূর্ণ ঘটনার জন্য চরম প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সম্ভাবনা বেশি হতে পারে।
 
একজন ব্যক্তি শৈশবে মানসিক চাপ অনুভব করলে এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডারের ঝুঁকি বেশি হতে পারে। অত্যধিক সুরক্ষামূলক (over protective) বা আপত্তিজনক ও কঠোর অভিভাবকত্ব (abusive parenting), পারিবারিক বাধা (family disruptions) এবং জীবনের প্রথম দিকে ঘন ঘন স্থান/ স্কুল পরিবর্তন একজন ব্যক্তিকে জীবনের ঘটনাগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম করে তুলতে পারে। যখন সমস্যা দেখা দেয়, তাদের মোকাবেলা করতে হিমশিম খেতে হয় তাদের।
 
অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যুদ্ধ বা সহিংসতার সংস্পর্শে আসা, জীবনের কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা।
জটিলতা (complications): যাদের অন্য মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি, যে কোন ভাবে মাদকাসক্ত বা একটি দীর্ঘস্থায়ী এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার রয়েছে তাদের দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: হতাশা, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা, অস্বাভাবিক আচরণ অথবা সাইকিয়াট্রিক ডিসঅর্ডার যেমন – সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, অসামাজিক ব্যক্তিত্বের ব্যাধি ইত্যাদি।
 
চিকিৎসা (treatment of adjustment disorder): এ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডারের জন্য প্রধানত দুই ধরনের চিকিৎসা আছে – সাইকোথেরাপি এবং ওষুধ।
 
সাইকোথেরাপি: একে কাউন্সেলিং (counselling) বা টক থেরাপি (talk therapy) ও বলা হয়। থেরাপি পৃথকভাবে, দলগতভাবে, পরিবারের সকলের সাথেও হতে পারে। কাউন্সেলিং মানসিক সাপোর্ট প্রদানে সহায়তা করতে পারে এবং রোগীকে স্বাভাবিক রুটিন জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করতে পারে। Counselling রোগীকে এটাও জানতে সাহায্য করতে পারে যে, কেন চাপের ঘটনা তাকে এতটা প্রভাবিত করে। রোগী এই সংযোগ সম্পর্কে আরও বেশি বোঝেন, তিনি ভবিষ্যতে উদ্ভূত অন্যান্য চাপের ঘটনাগুলির সাথে মোকাবিলা করতে সহায়তা করার জন্য স্বাস্থ্যকর মোকাবেলা (healthy coping skills) করার দক্ষতা শিখতে পারেন।
 
এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা (allopathic treatment): এ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস এবং অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধগুলি প্রায়শই adjustment disorder এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি counselling এর সাথে আরও ভাল কাজ করতে পারে। রোগীর কয়েক মাস থেকে এমনকি বছর পর্যন্ত চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। যদি হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করা হয়, বিশেষ করে কিছু নির্দিষ্ট এ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস তবে তা প্রত্যাহারের লক্ষণ (withdrawal symptoms) সৃষ্টি করতে পারে। এসকল ওষুধের অন্যান্য গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (side-effects) ও রয়েছে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা (homeopathic treatment): হোমিওপ্যাথ রোগী, তার পরিবারের সদস্য এবং এমনকি বন্ধু-সহকর্মীদের সাথে কথা বলে সামগ্রিক লক্ষণ সংগ্রহ করে। লক্ষণটি কখন, কি অবস্থায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিষয়াবলী- ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই হোমিওপ্যাথের জানা প্রয়োজন।
 অন্যান্য উপসর্গ নিম্নলিখিত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে জানা হয়: 
1. রোগী কি সমস্যাটি পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছেন?
2. কত ঘন ঘন দু:খিত বা বিষণ্ণ বোধ করেন?
3. আত্মহত্যার চিন্তা আছে কিনা? থাকলে কিভাবে পরিকল্পনা করছেন?
4. কত ঘন ঘন উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত বোধ করেন?
5. ঘুমের কোন সমস্যা আছে কিনা?
6. পূর্বে সহজেই যে কাজগুলি করা যেতো এখন তা করতে অসুবিধা হয় কিনা?
7. সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্ক/ ঘটনাগুলি কি এড়িয়ে চলেন কিনা?
8. স্কুল বা কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা?
9. তারা কি এমন কোন আচরণ বা কাজ করেন যা প্রকৃতপক্ষে তাদের আচরণ বা কাজ বলে মনে হয়না? 
10. অন্য কোন লক্ষণ বা আচরণ আছে কিনা, যা তাদের বা তাদের প্রিয়জনের কষ্টের কারণ হয়?
11. তারা কি মদপান বা অন্য কোন অবৈধ ড্রাগ সেবন করেন? যদি করেন তো তার বিস্তারিত তথ্য
12. তারা কি অতীতে অন্য কোন মানসিক ব্যাধির জন্য চিকিৎসা নিয়েছেন? নিলে কি ধরনের চিকিৎসা? তার ফল কি?
13. কোন বংশগ্রত রোগপ্রবণতা আছে কিনা (genetic predisposition) সমস্যা আছে কি?
14. সামগ্রিক জীবনধারা (overall lifestyle) কেমন?
 
সংগৃহীত উপসর্গের উপর ভিত্তি করে যে কোনো হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন নির্বাচিত হতে পারে যা সফলভাবে রোগীদের নিরাময় করবে। 
 
ওষুধের সাথে আরও কিছু বিষয় অনুসরণ করলে তা রোগীর জন্য খুব উপকারী হতে পারে যেমন:
1. পরিবার, সহকর্মী এবং বন্ধুদের সাথে একটি ভাল সমর্থন নেটওয়ার্ক (support system/network) স্থাপন করার ব্যবস্থা
2. আধ্যাত্মিক হওয়া, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা তথা সৃষ্টিকর্তাকে গভীরভাবে চেনা/জানা ও তার সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন
3. নির্দোষ বিনোদনের ব্যবস্থা করা
4. জীবনব্যাপী একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা (healthy lifestyle) পালন করা
5. নিজের সম্পর্কে ইতিবাচকভাবে চিন্তা (positive thinking) করতে শেখা