পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (Polycystic Ovary Syndrome or PCOS) প্রজননক্ষম নারীদের অন্তঃস্রাবী সিস্টেমের (endocrine system) রোগ। PCOS-এ আক্রান্তদের ডিম্বাশয় বড় হয়ে থাকে এবং কিছু তরল পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় যাকে ফলিকলস (follicles) বলে। এক বা উভয় ডিম্বাশয়ে এ অবস্থা থাকতে পারে যা আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে দেখা যায়।

অনিয়মিত বা দীর্ঘায়িত মাসিক, শরীরে বিশেষত: মুখে অবাঞ্চিত লোম বৃদ্ধি, ব্রণ এবং স্থূলতা সবই PCOS-এ আক্রান্তদের মধ্যে দেখা যায়। বয়:সন্ধিকালে অনিয়মিত বা অনুপস্থিত ঋতুস্রাব PCOS- এর বিশেষ আলামত।

লক্ষণ (symptoms): PCOS এর লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি প্রায়ই একটি মেয়ের প্রথম পিরিয়ড (menarche) শুরু হওয়ার পরপরই দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে PCOS প্রজননক্ষম নারীদের যে কোন সময় বিকাশ লাভ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উল্লেখযোগ্য ওজন বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় এরোগ দেখা দিতে পারে। রোগ নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিতগুলির মধ্যে অন্তত দুটির সন্ধান করা হয়:

1. অনিয়মিত পিরিয়ড/ ঋতুস্রাব: এটি সবচেয়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্য। উদাহরণ হিসেবে ৩৫ দিনের বেশি সময় পর পর মাসিক হওয়া, বছরে আটটিরও কম মাসিক ঋতুচক্র; চার মাস বা তার বেশি সময় ধরে মাসিক না হওয়া; এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প বা ভারী ঋতুস্রাব হওয়া।

2. অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন: পুরুষ হরমোন (androgen) এর উচ্চ মাত্রার ফলে কিছু শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন- মুখের অতিরিক্ত চুল এবং শরীরের লোম (Hirsutism), প্রাপ্তবয়স্ক ও কৈশোরের ব্রণ এবং পুরুষ-প্যাটার্নে চুল পড়ে টাক হয়ে যাওয়া (androgenic Alopecia)।

3. পলিসিস্টিক ডিম্বাশয়: পলিসিস্টিক ডিম্বাশয়ে (polycystic ovary) ওভারি বড় হয়ে যায় ও ডিমের চারপাশে অসংখ্য ছোট তরল-ভরা থলি থাকে।

কারণ (Causes of PCOS): নিম্নলিখিত কারণগুলি এই রোগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে:

অতিরিক্ত ইনসুলিন: ইনসুলিন হল অগ্ন্যাশয়ে উৎপাদিত হরমোন যা কোষকে চিনি (glucose) -র মাধ্যমে শরীরের প্রাথমিক শক্তি সরবরাহ করতে দেয়। যদি কারো ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা (insulin resistance) থাকে, তাহলে তার ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং কোষে গ্লুকোজ পৌঁছানোর জন্য অগ্ন্যাশয়কে অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরণ করতে হয়। অতিরিক্ত ইনসুলিন অ্যান্ড্রোজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ডিম্বাশয়কেও প্রভাবিত করতে পারে, যা ডিম্বাশয়ের ডিম্বস্ফোটনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

নিম্ন স্তরের প্রদাহ: শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা (white blood cell) প্রদাহ (inflammation) সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পদার্থ তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে PCOS-এ আক্রান্ত নারীদের নিম্ন-গ্রেডের প্রদাহ (low-grade inflammation) থাকে এবং এই ধরনের প্রদাহ পলিসিস্টিক ডিম্বাশয়কে এন্ড্রোজেন তৈরি করতে উদ্দীপিত করে।

বংশগত রোগপ্রবণতা: যদি রোগীর মা-খালা-নানী বা বোনের PCOS থাকে, তবে রোগীরও এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

জটিলতা (complications): পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় সিন্ড্রোম (PCOS) থাকলে নিম্নলিখিত রোগের সম্ভাবনা বেশি হতে পারে, বিশেষ করে যদি স্থূলতার কারণে এটি হয়:

1. টাইপ – ২ ডায়াবেটিস

2. উচ্চ রক্তচাপ

3. কোলেস্টেরল এবং লিপিড অস্বাভাবিকতা, যেমন উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড বা উচ্চ-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (HDL) কোলেস্টেরল বা “ভাল” কোলেস্টেরল কম থাকা

4. মেটাবলিক সিনড্রোম – লক্ষণ এবং উপসর্গের একটি ক্লাস্টার যা কার্ডিওভাসকুলার রোগের উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির ঝুঁকি নির্দেশ করে

5. নন-অ্যালকোহলিক স্টেটোহেপাটাইটিস – লিভারে চর্বি জমে একটি গুরুতর লিভারের প্রদাহ

6. বন্ধ্যাত্ব

7. স্লিপ অ্যাপনিয়া

8. বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ

9. জরায়ু হতে অস্বাভাবিক রক্তপাত

10. জরায়ুর আস্তরণের ক্যান্সার (endometrial cancer), ক্রমাগত উচ্চ মাত্রার ইস্ট্রোজেনের সংস্পর্শে আসার কারণে এটি হতে পারে

11. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ

চিকিৎসা (Treatment): এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো:

মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করা: ডাক্তাররা ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টিন উভয়ের সমন্বয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির পরামর্শ দেন যাতে করে মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কখনও কখনও প্রজেস্টেরন থেরাপি পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। কিছু ডাক্তার মেটফর্মিন লিখে দেন যা ইনসুলিন রেজিস্টেন্সের উন্নতি ঘটায়।

রোগীকে ডিম্বস্ফোটনে সহায়তা করা: যারা গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন, তাদের জন্য ডাক্তার ক্লোমিড সেবনের পরামর্শ দেন যা ডিম্বস্ফোটনে সহায়তা করে। যদি রোগী গর্ভধারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে মেটফর্মিন, ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) এবং লুটিনাইজিং হরমোন (LH) ওষুধ লিখে দেন যা ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।

অবাঞ্চিত চুলের বৃদ্ধি হ্রাস করা: স্পিরোনোল্যাকটোন ব্যবহারে পরামর্শ দেন চিকিৎসক যা ত্বকে এন্ড্রোজেনের প্রভাবকে ব্লক করে বা সীমিত রাখে। কিন্তু এ অবস্থায় গর্ভধারণ করলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। এই কারণেই কার্যকর গর্ভনিরোধের প্রয়োজন যাতে রোগী গর্ভবতী হতে না পারে। Eflornithine ধরনের ওষুধ যা একটি ক্রিম, মহিলাদের চুলের বৃদ্ধি ধীর করে দেয়।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা: হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অত্যন্ত স্বতন্ত্র (individualized treatment)। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করতে এবং PCOS নিরাময়ে সাহায্য করে। রোগীর সার্বিক উপসর্গ এবং জীবনধারা বিশ্লেষণ করে যে কোন ঔষধ নির্বাচিত হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলি প্রায়শই ব্যবহৃত হয়: এপিস মেলিফিকা, পালসেটিলা, সিপিয়া, ল্যাকেসিস গ্রাফাইটিস। হোমিওপ্যাথের সাথে পরামর্শ করার আগে, রোগীদের PCOS-এর জন্য নেয়া অন্য সমস্ত ওষুধ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করা হয় যাতে করে রোগীতে স্পষ্টভাবে সকল লক্ষণাবলী পাওয়া যায় ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।

জীবনধারা পরিবর্তনের পরামর্শ (lifestyle modification):

স্বাস্থ্যকর ওজন: স্থূলতা ইনসুলিন প্রতিরোধকে আরও খারাপ করে তোলে। ওজন হ্রাস ইনসুলিন এবং অ্যান্ড্রোজেন উভয়ের মাত্রা কমাতে পারে এবং এবং স্বাভাবিক ডিম্বস্ফোটন পুনরুদ্ধার করতে পারে। রোগীকে ছোট প্লেট ব্যবহার করতে হবে, ওজন কমাতে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয় প্লেটে খাবার গ্রহণের ইচ্ছাকে প্রতিহত করতে হবে।

খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন: কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার বিবেচনা করতে হবে। ফাইবার বেশি এমন জটিল কার্বোহাইড্রেট বেছে নিতে হবে। একটি খাবারে যত বেশি ফাইবার থাকে, তত ধীরে ধীরে এটি হজম হয় এবং আরও ধীরে ধীরে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। উচ্চ ফাইবার কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে রয়েছে – পুরো শস্যের রুটি, সিরিয়াল, পুরো গমের পাস্তা, বার্লি, বাদামী চাল, মটরশুটি ইত্যাদি। কম স্বাস্থ্যকর সাধারণ কার্বোহাইড্রেট যেমন – সোডা, অতিরিক্ত ফলের রস, কেক, ক্যান্ডি, আইসক্রিম, পাই, কুকিজ এবং যেকোনো ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার যা বর্জনীয়।

ব্যায়াম/শারীরিক পরিশ্রম: নিয়মিত ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে ইনসুলিন প্রতিরোধের চিকিৎসা হয় বা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে।