থাইরয়েড গ্রন্থি হতে যখন যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ ২ ধরণের হরমোন তথা – T4 বা Thyroxine এবং T3 বা Triiodothyronine  নি:সৃত না হলে তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। এর থেকে উৎপত্তি হয় জটিল জটিল সব স্বাস্থ্য সমস্যা। মহিলাদের এ রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশী।

Complications:

হাইপোথাইরয়েডিজমের সঠিক চিকিৎসা না করানো হলে তা পর্যায়ক্রমের শরীরে অনেক রোগ সৃষ্টি করে।

  1. কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা।
  2. উচ্চ রক্তচাপ – যা হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
  3. এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রার দিকে নিয়ে যায় যা এথেরোস্ক্লেরোসিস এবং হৃদরোগ সৃষ্টি করে।
  4. মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ – বিষন্নতা, খিটখিটে মেজাজ সহ নানা রকম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে।
  5. কগনিটিভ ফাংশন তথা স্মৃতিশক্তি হ্রাস সহ জ্ঞানীয় কার্যকলাপের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে।
  6. মাইক্সেডিমা (তীব্র হাইপোথাইরয়েডিজম): Myxedema যদিও বিরল তবুও অত্যন্ত জীবন-হুমকিপূর্ণ অবস্থা। গুরুতরভাবে কম থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা চরম দুর্বলতা, বিভ্রান্তি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে, অচেতনতা বা কোমা সৃষ্টি করে।
  7. প্রজনন সমস্যা: ঋতুচক্রের নানান গোলযোগ বিশেষত: বহুদিন যাবৎ মাসিক না হওয়ার কারণে নারীদের গর্ভধারণ হয়না। সুচিকিৎসা না পেলে স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়।
  8. মেটাবলিক সিনড্রোম: বিপাক ক্রিয়ার গোলযোগের কারণে স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, অস্বাভাবিক কোলেষ্টেরল ইত্যাদি দেখা দেয়।
  9. পেশীর দুর্বলতা ও জয়েন্টে ব্যথা এবং জয়েন্টের স্টীফনেস দেখা দেয়।
  10. নিউরোলজিক্যাল সমস্যা: নার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ হবার কারণে হাত-পায়ের পেশীতে অবশতা বা ঝিমঝিম ভাব।
  11. চুল ও ত্বকের সমস্যা: শুষ্ক, মোটা, রুক্ষ ও ফ্যাকাশে ত্বকের কারণ হতে পারে। চুল পাতলা, চুল পড়া বা ভঙ্গুর চুল অনুভব করতে পারে।
  12. গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল জটিলতা: হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিতে পারে, যার ফলে ভয়াবহ কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।
  13. শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: স্লিপ অ্যাপনিয়া সৃষ্টি করে। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে ঘুমের সময় বার বার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে।

হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ:

  1. ক্লান্তি এবং দুর্বলতা
  2. ওজন বৃদ্ধি তথা স্থুলতা
  3. মুখ ফোলাভাব
  4. ঠান্ডায় সংবেদনশীলতা
  5. কোষ্ঠকাঠিন্য
  6. শুষ্ক ত্বক এবং চুল চিকন, ভঙ্গুর নখ
  7. পেশীর ব্যথা, দুর্বলতা ও শক্তভাব সহ ক্র্যাম্প
  8. জয়েন্টে ব্যথা, স্টিফ, ফোলাভাব
  9. বিষণ্ণতা এবং মেজাজের পরিবর্তন
  10. স্মৃতিশক্তি-মনোযোগ-চিন্তাভাবনার সমস্যা
  11. অনিয়মিত ও অধিক ঋতুস্রাব  
  12. কন্ঠস্বর কর্কশ, গলা ফোলা বা গয়টার (ঘ্যাগ)
  13. কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা
  14. ধীর হৃদস্পন্দন।

ডায়গনসিস: হাইপোথাইরয়েডিজম নির্ণয় করতে বেশ কিছু পরীক্ষা করা হয় যেমন –

  1. TSH পরীক্ষা: TSH- এর উচ্চ মাত্রা নির্দেশ করে যে থাইরয়েড গ্রন্থি যথেষ্ট হরমোন তৈরি করছে না যা হাইপোথাইরয়েডিজম নির্দেশ করে।
  2. এছাড়া T3 (FT3)  এবং  T4 (FT4) পরীক্ষা।
  3. থাইরয়েড অ্যান্টিবডি পরীক্ষা:
  4. থাইরয়েড আল্ট্রাসাউন্ড:
  5. এফএনএ বায়োপপসি: ম্যালিগন্যান্সি পরীক্ষা করা হয়।
  6. কোলেস্টেরলের মাত্রা: এলডিএল কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা হাইপোথাইরয়েডিজম নির্দেশ করতে পারে।

এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা:

লেভোথাইরক্সিন (সিনথ্রয়েড, লেভোক্সিল, ইউথাইরক্স, ইত্যাদি):

লেভোথাইরক্সিন হল T4 হরমোনের একটি সিন্থেটিক ফর্ম, যা থাইরয়েড গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত থাইরক্সিনের অনুরূপ।

সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে বুক ধড়ফড় করা, ওজন হ্রাস, নার্ভাসনেস এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ

হোমিওপ্যাথির কাজই মানুষের নিজস্ব নিরাময় প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করা। হোমিওপ্যাথির লক্ষ্য রোগীকে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা করা এবং অসুস্থতার অন্তর্নিহিত কারণগুলিকে শনাক্ত করে তা দূর করা।  

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিতে রোগীর হ্রাস-বৃদ্ধিসহ নির্দিষ্ট শারীরিক-মানসিক লক্ষণ, মেডিকেল হিস্ট্রি, জীবনযাত্রার ধরণ, বংশগত রোগপ্রবণতা ইত্যাদি তথ্য দরকার।

হোমিওপ্যাথিতে হাইপোথাইরয়েডের জন্য ব্যবহৃত মোট ওষুধ ৬৩। যদিও এর বাইরে সার্বিক লক্ষণের উপর ভিত্তি করে  যে কোন ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলি ৫ টি ওষুধ:

Ammonium-muriaticum: মূল কাজ রোগীর সার্কুলেশন, পেশী এবং মিউকাস মেম্ব্রেন এবং গ্লান্ডের উপর। এর রোগী রিজার্ভড প্রকৃতির, এদের নির্দিষ্ট মানুষের প্রতি অনীহা থাকে। এরা নিরবে দু:খ সয়ে যায়। কাঁদতে পারেনা। ঘুম থেকে উঠার সময় সহজেই ভয় পায়। মনে করে পেশী এবং শিরায় টান লাগছে, নিম্নাংগ বিশেষত: পা, হিপ, পায়ের গোড়ালির ক্রাম্প বা স্পাজম। মনে করে এগুলো ছোট হয়ে গেছে। হাঁচি দিতে দিঁতে ঘুম থেকে উঠে। এরা স্থুল প্রকৃতির। শরীর মেদযুক্ত হলেও পাগুলি শরু। স্কাপুলার ভেতর বরফের মত ঠান্ডার অনুভূতি।

Calcarea carbonica: অত্যধিক শীতার্ত রোগী, স্থুলতার কারণে থলথলে শরীর। অনেক রকমের ভয় থাকে। যেমন- কুকুর, ইঁদুর, ভূঁত, বজ্রপাত, রোগ, মৃত্যু, দুর্ঘটনার ভয়। ক্যাল্কেরিয়ার রোগী আরোগ্যে হতাশ। ঘুমের ভেতর প্রচুর ঘামেন বিশেষত: ঘাড়ের পিছন দিকে, বুকে ও মাথায়। এদের নখ নরম ও ভংগুর। এরা ডিম ও মিষ্টান্ন খুব পছন্দ করেন। কিন্তু দুধ পানে অনীহা। ঠান্ডা সহ্য করতে পারেন না। গরম আবহাওয়ায় ভাল থাকেন।

Ferrum metallicum: রক্তশুন্যতা প্রধান লক্ষণ। অত্যন্ত সেন্সিটিভ ও উত্তেজনাপ্রবণ। কারো মতের সাথে সামান্য অমিল সহ্য করতে পারেন না। এছাড়া সামান্য শব্দে রেগে যান – যেমন কাগজ মোচড়ালে যে শব্দটুকু হয় তাতেই তারা ক্ষেপে যান। শরীর, ঠোঁট, মুখমন্ডল, জিহ্বা ফ্যাঁকাশে। ব্যথা, হৃদস্পন্দন, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি ধীরস্থির ভাবে চলাফেরায় তাদের অনেক কষ্ট উপশম হয়। স্থির থাকলে কষ্ট বাড়ে। মনে করে চলাফেরা না করলে সার্কুলেশন ঠিকমত হয়না। খাওয়া মাত্রই বমি করে ফেলে। অনেকের থুথুতে রক্ত আসে বা নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। এদের ডিমে অনীহা এবং ডিমে লক্ষণ বৃদ্ধি পায়। টমাটো পছন্দ করে।

Graphites: চর্মরোগ প্রবণতা যাতে আঠালো ডিসচার্জ থাকে। শরীর স্থুল, পুরু নখ। এরা খুবই সাধারণ, নম্র ভদ্র টাইপের মানুষ। কাজকর্মে স্লো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। সংগীতে সংবেদনশীল। গান শুনে কাঁদতে থাকে। চর্মরোগ চাপা পড়ে নানান অসুস্থতা বিশেষত: পাকস্থলীর গোলযোগ। এদের মলদ্বারে ও ঠোঁটের কোনায় ফেঁটে যায়। আলোকআতংকে ভোগে। শরীরের বিভিন্ন অংশে অবশভাব থাকে। মুরগীর মাংশ এদের খুব পছন্দ। লবন, মিষ্টান্ন, মাছ, গরম খাদ্যে অনীহা।

Opium: ঘুম ঘুম ভাব সহ সদানন্দ চিত্ত। স্থুল শরীর।  এরা অনেক সময় ঘুমের ভেতরেও হাটাহাটি করেন (Somnambulism)। কথা বলতে বলতে বা বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। কষ্টে ভুগলেও পাত্তা দেননা। সবসময় প্রফুল্ল ভাব ধরে রাখেন। অভিযোগ করেন না। তেমন কিছুর চাহিদা নাই। অসুস্থ হলেও বলেন ভাল আছি। লক্ষণ কষ্টদায়ক হলেও তারা তেমন অনুভব করেন না। মারাত্মক কোষ্ঠ্যকাঠিন্য। মলদ্বার যেন কাজ করে না। মল এসেও ফিরে যায়। কিছু ক্ষেত্রে কালো বলের মত মল দেখা যায়। পর্যায়ক্রমে ডায়রিয়া ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য।

হাইপোথাইরয়েডিজমের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে এর জটিলতাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে। জীবনধারার পরিবর্তন অপরিহার্য। আপনি যদি মনে হয় হয় যে আপনার হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ অনুভব করছেন, তাহলে সঠিক চিকিৎসার জন্য আজই দক্ষ ও অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথের শরণাপন্ন হোন। ইনশাল্লাহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এমন চিকিৎসা আজীবন গ্রহণের দরকার হবেনা।

রেডিয়েশন এক্সপোজার থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে রক্ষা করুন। বিশেষ করে ঘাড় ও মাথার দিকে কোন রেডিয়েশন এক্সপোজার থাকলে এ রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।