হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররা রিপোর্ট বুঝেন না এমনটা নয়। আজকের আলোচনার বিষয় – আমরা কি রিপোর্ট নির্ভর চিকিৎসা দিব নাকি রোগীর কষ্ট তার মুখে শুনেই চিকিৎসা দিব?

রোগ আসলে রোগীর অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা। যা হতে পারে রোগীর শারীরিক-মানসিক-আবেগিক – যে কোন স্তরে। অতএব প্যাথলজি কেবল শারীরিক রোগের – বিষয়টি একদমই এমন না। আমরা বহু শারীরিক রোগের কারণ হিসেবে ইমোশনাল বা মেন্টাল প্যাথলজির প্রাধান্য দেখতে পাই।

এ্যালোপ্যাথিক ডাক্তাররা নি:সন্দেহে ব্রিলিয়্যান্ট। কিন্তু তারা ল্যাব রিপোর্ট দেখা ছাড়া তেমন কথা বলেন না, বলতে চাননা বা তাদের সিস্টেমে ডায়গনসিসের জন্য যে রোগীর সাথে কথা বলতে হয় এবং সেই কথা বলে যে রোগীর জন্য প্রেসক্রাইব করা যায় – এই ধারণাটি অনুপস্থিত। ছোটবেলায় এ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারদের দেখতাম চোখের পাতা টেনে দেখতেন, জিহ্বা দেখতেন, আংগুলের ডগায় চাপ দিয়ে পরখ করতেন। ইদানীং আর এসব দেখা যায়না। ডাক্তারের সময় কই? ডাক্তার রোগীকে কতক্ষণ সময় দেন?

আপনি জেনে অবাক হবেন যে বিশ্বখ্যাত হোমিওপ্যাথ প্রফেসর জর্জ ভিথোলকাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তার এথেন্স ক্লিনিকে মাসে ২২০০ রোগী দেখা হয়। ৩০ জন ডাক্তার – যারা সবাই তাঁর নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তারা এই সংখ্যক রোগী দেখেন। মাসে একজন ডাক্তার কজন রোগী দেখেন? ৭৫ জন। বলা বাহুল্য রোগীদের প্রায় সকলেই ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, সহ নানা দেশ থেকে আসেন। যাদের রোগকে তথাকথিত আধুনিক ডাক্তাররা অনারোগ্য ঘোষণা করেছেন এবং জীবনব্যাপী চিকিৎসা চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথিই শেষ ভরষা মনে করে তাদের ওখানে আসা। এবং তারা একসময় সফল চিকিৎসা পান। কারণ অনারোগ্য বলে কোন রোগই নেই।

আমরা কি করি? কিভাবে কেস নিই?

কেস টেকিং অর্থাৎ রোগীর প্রধান রোগ, আনুষংগিক শারীরিক মানসিক লক্ষণ, রোগের কারণ, হ্রাস-বৃদ্ধির ধরণ, জীবনযাত্রার বিশৃংখলা – সহ সব কষ্ট শুনে তা রেকর্ড করাই আমাদের কাজ। এটিই সফলতার ৫০%। তারপর প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং প্রেসক্রাইব করা এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর ফলোআপ করা। এটা ২-১ মিনিটের কাজ নয়।

Objective Symptoms তথা ল্যাব টেস্টের গুরুত্ব আমাদের কাছে ৫-১০%। আর রোগীর কথা তার মুখে শোনার গুরুত্ব ৮০%। এটাকেই আমরা Subjective Symptoms বলি। বাকীটা আমাদের পর্যবেক্ষণ। ল্যাব টেস্টে যে রোগের ডায়গনসিস হয় তা কি প্রকৃত রোগ? – নাকি রোগের ফল? তা ভাবা দরকার।

কেউ যদি বলেন – “আমার সমস্যা কেবল ডায়বেটিস, বাকী সব দিক হতে আমি সুস্থ”। তার কথা আমরা মানি না। তার ডায়বেটিসের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ গল্প। এ্যালোপ্যাথিক ডাক্তাররা এদের রিপোর্ট ছাড়া আর কিছুই দেখেন না বলে শত শত রোগের ন্যায় তাদের কাছে ডায়বেটিস ও অনারোগ্য। ডায়বেটিস রোগের জন্য চিকিৎসার উদ্দেশ্য কেবল সুগার নরমাল লেভেলে রাখা, নিরাময় নয়। সব ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীর গল্প আলাদা, কারণ ভিন্ন – চিকিৎসাও পৃথক হবে আমাদের কাছে।

কেস নেয়ার সময় এতকথা আমরা কেন শুনতে চাই? কারণ একটাই। সেটা হলো নির্দিষ্ট রোগীকে তার মত অন্য রোগীদের থেকে কেবল পৃথক – ই নয় বরং স্বতন্ত্র বা Unique হিসেবে জানান চেষ্টা করা। কেন রোগীটি স্বতন্ত্র তা জানতে পারলে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারলেই সফলতা আসে। এ্যালোপ্যাথদের মত মিল খোঁজা আমাদের কাজ না। যে কারণে তারা একই রোগে এক জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকেন সবাইকে। তাদের লক্ষ্য আরোগ্য নয়; উপশম। আমাদের উদ্দেশ্য আরোগ্য। ১০ জন এ্যাজমা রোগীর ১০ রকম ওষুধ হতে পারে। কারণ, সবার পেক্ষাপট ভিন্ন। সবারই কিছু Unique feature আছে যা অন্য সবার থেকে পৃথক। যেমনটি আপনার আংগুলের ছাপ একেবারে স্বতন্ত্র্য। কারণ আলাদা, জীবনযাত্রার ধরণ আলাদা, লক্ষণের হ্রাস-বৃদ্ধির প্যাটার্ণটা আলাদা। চিকিৎসাতো পৃথক হবেই।

আমাদের কাছে সকল রোগীই একটা মেইন কমপ্লেইন নিয়ে আসেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা কোন না কোন শারীরিক সমস্যা। তাদের অনেকেরই এই ধারণা থাকেনা যে ডাক্তার তার প্রধান লক্ষণ বা রোগের বাইরে অনেক কিছুই শুনতে চাইবেন।

আমরা রোগীর কথা তার মুখে শুনতে চাই। তার নিজের ভাষায়। রোগীর সাথে কেউ আসলে তার সাথেও কথা বলার চেষ্টা করি। ডাক্তার হিসেবে আমাদেরও থাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। আর ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে আমাদের ভরষা ২টি – বাবা-মা বা কেয়ার গিভারের পর্যবেক্ষণ, প্লাস আমাদের পর্যবেক্ষণ। খাওয়া-ঘুম-পায়খানা প্রস্রাব-আচরণ কোন কিছুকেই আমরা ইগনোর করিনা। না জানি কোথায় পাওয়া যাবে রোগের মূল রহস্য তথা বিশৃংখলার সন্ধান! ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাস রোগের মূল কারণ নাও হতে পারে।

কিছু ধারণা দেবার জন্য সম্প্রতি আসা একজন শ্বাসকষ্টের রোগীর কেসটা শেয়ার করি:

রোগীর বয়স ২২। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন রত।

তার প্রধান সমস্যা এ্যাজমা বা হাঁপানী। ১০ বছর ধরে ভুগছেন। তার যেসকল লক্ষণের উপর ভিত্তি করে আমরা প্রেসক্রাইব করি তা হলো –

  1. ঠান্ডা বাতাসে শ্বাসকষ্ট হয়, বিশেষত: এসির বাতাসে এবং শীতকালে,
  2. শয়নে শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায়, সোজা হয়ে বসলে আরাম পান,
  3. ধুলোবালি হতে শ্বাসকষ্টের উদ্রেক হয়,
  4. সামান্য পরিশ্রম করলে – যেমন একটু দ্রুত হাটলে, সিঁড়ি বেয়ে ৩/৪ ফ্লোর উঠলেই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়,
  5. ঋতুর পরিবর্তনে তার কষ্ট অধিক যেমন – ঠান্ডা থেকে গরম বা গরম থেকে ঠান্ডায় লক্ষণ বাড়ে,
  6. শ্বাসকষ্টের সাথে অনেক সময় কাশি-সর্দি থাকে।

তার অন্যান্য লক্ষণগুলি হলো:

  1. চর্মরোগ যা বেশ কয়েক বার স্টেরয়েড দিয়ে দমন করা হয়েছে,
  2. এ্যালার্জিক সমস্যা যা মূলত: গরুর মাংশ, চিংড়িমাছ, বেগুনে দেখা যায়, এছাড়া ঠান্ডা, ধুলোবালি থেকে নাক-চোখ-ত্বক চুলকায়,
  3. সার্বিকভাবে রোগী গরম আবহাওয়া পছন্দ করেন,
  4. রোগী শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল।
  5. গাড়ীতে চড়ে ভ্রমণ করলে তার বমির ভাব, এমনকি বমি হয়।
  6. পিপাসা অত্যধিক।
  7. রাতে ঘুমের ভেতর মুখের লালা গড়িয়ে পড়ে।
  8. নাকে অধিকাংশ সময় পানির মত পাতলা সর্দি থাকে।
  9. পর্যায়ক্রমে ডান-বামের নাসারন্ধ বন্ধ থাকে, একসাথে ২টি বন্ধ থাকাটা রেয়ার।

মানসিক যে সকল লক্ষণ পাওয়া যায়

  1. আত্মবিশ্বাসের যথেষ্ট ঘাটতি।
  2. রোগীর সাহসের খুব অভাব, নিজেই নিজেকে কাপুরুষ মনে করেন।
  3. ছোটবেলা থেকেই কোন বন্ধু-বান্ধব নাই। এখন মন চাইলেও কারো সাথে মিশতে পারেন না।
  4. আবেগপ্রবণ, কিন্তু কারো সাথে শেয়ার করেন না।
  5. পারিবারিক কিছু বিষয়ে নিকট আত্মীয়দের ঘৃণার চোখে দেখেন।
  6. রোগী অত্যন্ত অস্থির এবং নার্ভাস প্রকৃতির।

রোগীর কেসটি আমাদের নিকট স্পষ্ট। লক্ষ্য করলে দেখবেন এই রোগীর ১০০% লক্ষণই সাবজেক্টিভ লক্ষণ। অর্থাৎ রোগী শেয়ার না করলে আমাদের জানার তেমন উপায় ছিলনা। এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় এ্যাজমা অনারোগ্য। অতএব সারাজীবন চিকিৎসা চলবে। আমাদের চিকিৎসায় ইনশাল্লাহ্ তিনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।

Objective Symptom জানার জন্য রোগীর সাথে কথা বলার কোন দরকার হয়না। নানা রকম ল্যাব টেষ্ট করা হয়। Test Value নরমাল রেন্জের বাইরে গেলেই রোগ ডায়গনসিস হয়। রিপোর্ট নরমাল হলে ডাক্তার রোগীর সমস্যা “মানসিক” বলে তাকে পরিত্যাগ করেন। আমাদের নিকট বহু লোক আসেন যাদের test reports 100% নরমাল। অথচ মানুষগুলো মারাত্মক সিঁক। বিচিত্র সব মেন্টাল-ইমোশনাল প্যাথলজিতে আক্রান্ত তারা। কেউ বা ভুগেন আইবিএসে, কেউ অনিন্দ্রায়, কেউবা মারাত্মক কোষ্ঠ্যকাঠিন্যে বা মানসিক কোন রোগে। হোমিও চিকিৎসায় এরা দ্রুত ফল পান। কারণ, হোমিওপ্যাথি রোগ নয়; রোগীর চিকিৎসা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *